ঝড় – বিদিশা মুখার্জি
অসম্ভব পেটের যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠছে সন্ধ্যা । বাইরে তুমুল ঝড়ে চারদিকে শুধু মড়মড় শব্দ। এইসময় দায়মাকে ডাকতে যেতে হবে, ভাবলেই শিউড়ে উঠছে সুবল। ভরামাসের পোয়াতি সন্ধ্যার যে আজকেই বিয়োতে হবে ,তা কে জানত!
ঘরে আটবছরের নন্তে ছাড়া কেউ নেই যার কাছে এই অবস্থায় প্রসবকাতরা রমণীকে দায়িত্ব দিয়ে দায়কে ডাকতে যাওয়া যায়। ওদিকে বাইরের দূর্যোগ যে মাত্রা ছাড়াচ্ছে তা ঝড়ের একটানা গোঁ-গোঁ আওয়াজ শুনলেই বোঝা যায়।
সন্ধ্যার চিৎকারে আকাশও যেন কেঁদে চলেছে অঝোরে। সুবল আর সাহস পায়না বসে থাকতে,নন্তেকে বলে মায়ের কাছে থেকে অন্যকোথাও যেনো না যায়। তারপর মাথালি মাথায় বেরিয়ে পরে গাঁয়ের শেষপ্রান্তে থাকা দায়কে ডেকে আনতে।
আজ যেন গোটা আকাশ ভেঙ্গে পড়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে। অন্ধকারে দু’হাত আগের রাস্তা দেখা যায় না, বিদ্যুৎ-এর ঝলকানিতে কোনোরকমে পথ চিনে এগোচ্ছিলো সুবল। হঠাৎ পায়ের গোঁড়ালিটা চরম জ্বালা করে উঠলো। কোথায় যেন বিকটশব্দে বাজ পড়লো। আলোর ঝলকানিতে কালোরঙের যমকে মাটির বুকে সরসরিয়ে যেতে দেখতে পেলো শুধু।
অনেকক্ষণ মানুষটাকে ফিরতে না দেখে ঐ যন্ত্রণার মধ্যেও সন্ধ্যা ছটফট করতে লাগলো, এদিকে জলভেঙে গেছে তার। প্রসবযন্ত্রণার থেকেও উৎকন্ঠায় মৃতপ্রায় সন্ধ্যা নন্তেকে ডাকতে গিয়ে দেখলো ছেলেটা কাছে নেই। ব্যাথা আর উৎকন্ঠার মধ্যে ছেলের কথা মনে ছিলো না তার। এবার সে কি করে?
উপায়ান্তর না দেখে কোনোরকমে ঘরের দাওয়াই এসে পুকুরঘাটের দিকে মুখ করে ছেলের নাম ধরে ডাকতে থাকে। ঝড়ের নাগাড়ে সোঁ-সোঁ শব্দের সাথে সেই ডাক যেন হাহাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আবার প্রসবযন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় সে। আস্তে আস্তে জ্ঞান হারায় সন্ধ্যা।
সকালের নরম আলোয় উঠোনে পড়ে থাকা দুটো কাপড়ঢাকা দেহ আর কোলের কাছে থেকে একটু দূরে পড়ে থাকা রক্তের পুঁটলি দেখে গতরাতের ঝড় সন্ধ্যার মনের কোণে প্রবল আলোড়ন তোলে। আশপাশের মানুষের গুঞ্জনে তার হতভাগ্যের কাহিনী বেজে চলে।
আজ তিনদিন হয়ে গেলো সর্বস্ব হারিয়ে কাঁদতেও ভুলে গেছে সন্ধ্যা। এই পাথরপ্রতিমার দিকে চাইতেও আর ভয় করে। এক জায়গায় বসে শুধু দূরের দিকে বোশেখের খটখটে ধানের ক্ষেতের মত তাকিয়ে আছে। কোথাও পেলবতার ছোঁয়া নেই সদ্য স্বামী-সন্তানহারা এই রমনীর সর্ব্বাঙ্গে। যেন নিজের সর্বসত্ত্বা দিয়ে নীরবে জেহাদ ঘোষনা করছে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে। পাশের কুঁড়ে থেকে মিনতি দু’বেলা সান্কিতে করে খাবার নিয়ে এসে তার সামনে ধরেছে, কিন্তু সাহস করে খেতে বলতে পারেনি। সন্ধ্যা সে থালার দিকে ফিরেও চায়নি। দিন চলেছে দিনের নিয়মে। কোনো শোকই চিরস্থায়ী নয় তাই ধীরে ধীরে পাড়া-প্রতিবেশীও নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যাকেও প্রকৃতির নিয়মে উঠে বসতে হয়েছে। তবে স্বাভাবিক নয় সেই চলাফেরা, তাতে যেন কিছুর বিরুদ্ধাচরণ করার অস্থিরতা আছে। যদিও সন্ধ্যা জানে না কার বিরুদ্ধে তার এই নালিশ,তবুও এক আক্রোশ ফেটে পড়ছে মনে।
আজ পনের দিন পরে আবার কালোমেঘে ছেয়ে গেছে চারদিক, অপরাহ্নের আলো মুছে গাঢ় অন্ধকারে অকালসন্ধ্যা নেমে এসেছে। খানিকপরে শুরু হলো তুমুল ঝড় সঙ্গে বজ্রপাত। সন্ধ্যা বেরিয়ে এলো কুঁড়ে থেকে। মূর্তিমতী ধ্বংসস্তুপ যেনো !
এগিয়ে চললো রিক্তা নারী উদ্দাম ঝড়ের মধ্যে, যা শুধু বাইরেই প্রবলবেগে বইছে না। মনের মধ্যেও তার গতি অপ্রতিরোধ্য। দূরে কোথাও বাজের হুঙ্কারে কানে তালা ধরে গেলো পল্লীবাসীর। এই শব্দ অশ্রুতপূর্ব, যেন এক প্রবল যন্ত্রণার হাহাকারও মিশে গেলো সেই আওয়াজের সাথে। দূর্যোগের রাত বড় লম্বা হয়,তবে সবকিছুরই তো শেষ আছে। রাতের ঝড়ে শ্রান্ত সময় তার নিদ্রালু চোখ মেললো ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে।
ঘরে ঘরে শুরু হলো দৈনিক জীবন। মিনতি তার হাঁসগুলোকে নিয়ে পুকুরপানে যাওয়ার আগে সন্ধ্যার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো একটা কালোকুকুর রাতের খাবার খেয়ে ভীষণ লজ্জায় কেঁউকেঁউ করতে করতে বেরিয়ে আসছে,আর ঘরটা যেনো খাঁ-খাঁ করছে। এত সকালে কোথায় গেলো সন্ধ্যা,ভাবতে ভাবতেই পাড়ার একটি ছেলে দৌড়তে দৌড়তে এসে জানালো সন্ধ্যামাসি বাজ পড়ে মরে গেছে, খালের ধারে তার দগ্ধশরীর পড়ে আছে।