করোনা : দ্য আদার সাইড
সুনীলকুমার সরকার
স্বাভাবিক ভাবেই গৃহসহায়িকা বা পরিচারিকাদের কাজে আসতে বারণ করেছিলেন । সহানুভুতির সঙ্গে বুঝিয়েই বলেছিলন --- এখন আসতে হবেনা , সাবধানে থেকো । কাজ চলে যাওয়ার ভয় , চিন্তা বা আশঙ্কা যে তাঁদের ছিলনা , তা নয় , কাজ না করিয়ে কি কেউ মাইনে দেয় ! আপনি দিয়েছেন । যাঁদের ফোন আছে , মাসের শেষে ফোন করে ডেকে মাইনে দিয়েছেন । যাঁদের ফোন নেই , খবর পাঠিয়ে ডেকে মাইনা দিয়েছেন । সঙ্গে জানিয়েছেন , মাসের শেষে আবার মাইনা নিয়ে যেতে । বৃদ্ধ বৃদ্ধা বা যাদের শারীরিক খুব অসুবিধা , বাধ্য হয়ে , দেড় দু'মাস পর থেকে কাজে ডেকেছেন , প্রথমদিকে দু'দিন একদিন অন্তর ...। প্রত্যেক মাসে মাইনে তো দিয়েছেন সঙ্গে বাড়তি কিছু খাদ্যসামগ্রীও । বাইরে থেকে এসে বাড়িতে যে সাবান দিয়ে আপনি হাত ধুচ্ছেন সেই সাবান দিয়েই হাত ধুতে বলছেন , কনুই থেকে । আপনি যে ত্রিস্তরিও মাস্ক পড়ছেন সেই মাস্কই নিজের হাতে দিচ্ছেন পরিচারিকাকে , মুখে পড়ার জন্য । আপনি জেনে গেছেন , শুধু নিজে সাবধানে থাকলেই হবে না , আশপাশের যাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা , তাঁদেরও সাবধানে থাকতে হবে , রাখতে হবে । আপনার থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে , আবার অন্যের থেকেও আসতে পারে । উভয়পক্ষকে একই রকম সাবধানতায় থাকতে হবে , নইলে পারস্পরিক ক্ষতি ! হ্যাঁ , এর মধ্যে ওঁদের বকাবকিও কম করেছেন। এই করোনা মমত্ববোধসহ একটা সাম্যের অনুভূতি এনে দিচ্ছে । সমাজের গরীব মানুষসহ ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের দুরাবস্থা আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে , আপনাকে নাড়া দিয়েছে , কষ্ট পেয়েছেন , অন্তত ভেবেছেন কিছু একটা ভালো হওয়া দরকার ওঁদের জন্য ! দিদিমনি মাস্টারমশাইরা অনেক কনফিডেন্স পাচ্ছেন , বিদ্যালয় ও স্থানীয় এলাকায় স্বচ্ছতা অভিযান অনেক সুগম হবে । ছাত্ররা মানসিকভাবে তৈরি হয়ে গেল আর শিক্ষকেরা আন্তরিক হয়ে কার্যকরী ভূমিকা নেবেন , আগের থেকে অনেক বেশি । স্বার্থ যেখানে পারস্পরিক !
যে ছোটখাটো অসুখে আপনি নিত্য ভুগতেন , জ্বর সর্দি-কাশি , শ্বাসকষ্টসহ পেটের অসুখ এখন কম হচ্ছে । মাস্ক পড়ার ফলে দূষিত বায়ু ও ডাস্ট আটকাছে , সাবান-হ্যান্ড স্যানিটাইজার এর ব্যবহার , পোশাক পরিচ্ছদ ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে । এই স্বচ্ছতা , পরিচ্ছন্নতা ও জনস্বাস্থ্যের প্রতি ইতিবাচক আচরণ সাধারণভাবে অসুখ কমাচ্ছে । চেম্বারে ডাক্তারদের সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অথবা স্যানিটাইজার ব্যবহারকে আমরা ভেবেছি , ওটা বুঝি ডাক্তারবাবুদের ব্যাপার , আমাদের নয় ! ওটা বুঝি সফিস্টিকেটেড লোকেদের ব্যাপার ,আমাদের নয় , অতটা স্যানিটেশন মেনে চলা আমাদের দরকার নেই ! আজ করোনা শিখিয়ে দিল , এ মেনে চলা সকলের জন্য । এখন ঘর মোছার জন্য হোক বা হাত ধোয়ার জন্য বা ব্যবহৃত জিনিসপত্র পরিচ্ছন্ন করার জন্যই হোক , অনেক বেশি ডিসইনফেকট্যান্ট কিনছেন ও ব্যবহার করছেন । যা করা উচিৎ ছিল আপনি আমি করতাম না । আমি আপনি সব্জী কিনে এনে এত ধুতাম না , গরম জল বা সার্ফ বা খাবার সোডা দিয়ে ভিজিয়ে রাখতাম না । ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক বা ভিখারীরাও জানেন , কোন খাবারগুলি পুষ্টিকর বা স্বাস্থ্যকর , ফল খেলে যে উপকার হয় তা সবাই জানেন। এখন যাঁরা পারছেন , পারতপক্ষে এই খাবারগুলি খাচ্ছেন , অন্যদিকে খরচ কমিয়েও । আপনি জানতেন এবং বলেও এসেছেন , নিয়মিত শরীরচর্চা উপকারী এবং অবশ্যই করা উচিত কিন্তু করতেন না । এখন সঠিক পদ্ধতি না জানলেও সকাল সন্ধ্যে একটু চেষ্টা করছেন । হাতে স্মার্টফোন আছে বা এর তার কাছ থেকেও শেখার চেষ্টা করছেন ।
আপনি এখন ভাবছেন এবং শপথ নিচ্ছেন , এখন থেকে এই বোধ-অনুভূতি , আচরণ , অভ্যাসগুলি জারি রাখবেন । প্রথমদিকে ভেবেছিলেন , আমি আক্রান্ত হবো না , ইম্যুনিটি আছে আর সাবধানেও তো আছি ! পরে দেখছেন , আপনার চেয়েও বেশি ইম্যুনিটিযুক্ত মানুষ , সাবধানে থাকা মানুষদেরও হচ্ছে । অনেক ক্ষমতাশালী ও আর্থিক সম্পন্ন , যারা অনেক ভালো চিকিৎসা পেতে পারেন , তাঁরাও মারা যাচ্ছেন । একজন করোনা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা যে কতটা জটিল ও অসম্মানের , তা আপনি জেনে গেছেন । কেউ মারা গেলে সৎকারের লোক পাওয়াও মুশকিল । আপনি ভাবতে পারেন , আপনার খানিক প্রভাব আছে , জানাশোনাও আছে , তেমন অসুবিধা হবে না । মৃত্যুর খবর শুনে যাঁরা আসবেন , তাঁদের মধ্যেও কিছু 'আহা , উহু' করে শোক জানিয়ে 'কিছু হেল্প লাগলে বলবেন' বলে বিদায় নেবেন । সোশ্যাল মিডিয়ায় কতগুলি RIP , ভালো মানুষ ছিলেন , আত্মার শান্তি কামনা করি থেকে স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই ! হাতে স্মার্ট ফোন আছে , নেটও সস্তার ! একটু সময় দিলেই হলো , সবটাই দূর থেকে । যদি শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান করেন , বিশেষ কেউ আসবেন না । অছিলা তো আছেই 'শ্রাদ্ধের খাওয়া খেতে খুব কষ্ট হয় , পারিনা , মানুষটির মুখ ভেসে ওঠে , এত ভালো মানুষ ছিলেন' অথবা 'আজ স্ত্রী উপোস করেছেন' ইত্যাদি ইত্যাদি !
লকডাউনে বা এখনও বিশেষ বাইরে বের হচ্ছেন না। হাতে অনেক সময় । অনেকের সাথে অনেকদিন কথা হয়নি , কেমন যে আছেন ! ফোন করছেন , কুশল কামনা করছেন । পাশে থাকার অঙ্গীকার করছেন আর পাশে পাওয়ার কামনাটাও সংগোপনে ঝালিযে নিচ্ছেন । প্রথমদিকে সারাদিন বাড়িতে থাকাটা বিরক্তিকর হলেও কিছু করার ছিলনা , new normal , আপনার বাড়িতে যে খিটিমিটি লাগেনি , কাজ নিয়ে ঝগড়া হয়নি বা ছেলেমেয়েদের খানিক বকেননি , তা নয় । এখন বাড়ির মধ্যেই একটা রুটিন তৈরি হয়েছে , ছেলেমেয়ে-বাবা-মা'সহ আপনারও । নতুন পরিস্থিতিতে নতুন সহাবস্থান , ভালো থাকার নতুন অভ্যাস !
এরই মধ্যে লুঠের রাজনীতি দেখছেন , বাক্যবাগিস রাজনীতি দেখছেন , ভোটের আগমনী সুর শুনছেন । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তিমি-তিমিঙ্গেলদের লড়াই , আস্ফালন শুনছেন । পাল্টাও চলছে , খানিক গটআপ-গটআপও ঠেকছে ! রাজনীতির প্রতি আপনার বিরক্তি-ঘেন্না আসছে ! আবার ভাবছেন , সমাজে রাজনীতির উর্দ্ধে কিছু থাকে , না কি ? অরাজনৈতিক থাকার অর্থ স্বার্থপরতা , টানাপোড়েনের এক জটিল যাপন ! এই করোনা , যুদ্ধ , জঙ্গী , সাদা-কালো'কে ভর করেই 'একুশে' নেমে আসবে ।
আপনি আমি দেখলাম প্রকৃতির ওপর অত্যাচার করলে , তাকে যথেচ্ছ ভোগ করলে সে যে প্রতিশোধ নেবেই ! লকডাউনে কম বিষ ঢালছি , সাময়িক লুঠ কমিয়েছি , প্রকৃতি সুন্দর-বিকশিত হয়ে আমাদের বন্ধু হয়ে চলছে । সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে পৃথিবী আবার শান্ত হবে , শিখলাম-জানলাম। ছোট্ট মেয়ে গ্রেটা থুনবার্গ হয়ত আশার আলো দেখছেন ।
দেশের মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ অর্গানাইজড সেক্টরে কাজ করেন , তাঁরা নিয়মিত মাইনে পত্তর পাচ্ছেন । সুযোগ কম থাকায় খরচও আপনি কম করছেন , কিছুটা মিতব্যয়ী হয়ে আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করছেন । স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা সঞ্চয় বেড়েছে ,পৃথিবী শান্ত হলে এই স্বল্পসঞ্চয় নিয়ে কিছু একটা যে করবেন , এটাও ঠিক করে রেখেছেন । তবে একটা অংশ আপনি দুঃস্থদের দানধ্যানও করছেন , ভবিষ্যতেও করবেন ঠিক করেছেন। আপনার মনে হয়েছে--- এই সবাইকে নিয়েই ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে , শুধু 'আমি' বাঁচলে পৃথিবীতে বড্ড একাকীত্ব !
আপামর মানুষ নতুন করে শিখছেন , ন্যুনতম একটা সঞ্চয়ের প্রয়োজন আছে । গরীব মানুষের হাতে টাকা নেই , কিন্তু ঠারে ঠারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ---এবার আয় শুরু হলে একটু হলেও পয়সা হাতে রাখবেন , কখন কী সময় আসে ! অর্থনীতিতে সঞ্চয়ের একটি প্রচলিত রুল আছে , ৫০/৩০/২০ , অর্থাৎ আয়ের অন্তত কুড়ি শতাংশ সঞ্চয়ের চেষ্টা করত হবে । প্রশ্ন হলো , গরীব মানুষ কি পেরে উঠবেন !
আজ ২৫শে জুন , লকডাউন ঘোষণার তিন মাস । সংক্রমণ বাড়ছে দ্রুত । সংক্রমণের চিত্র নিম্নরূপ :
তারিখ ভারত প.বঙ্গ
আক্রান্ত মৃত আক্রান্ত মৃত
-----------------------------------
২৫/৩ ৬১৮ ১৩ ১০ ১
২৫/৬ ৪.৭৫L ১৪.৬Th ১৫.৩Th ৬H
-------------------------------------
L = লক্ষ ,TH = হাজার H=শতক
অনুভবে তো অনেককিছুই পেলাম আমি আপনি , সংক্রামন থেকে রেহাই পাবো তো ! তবে ইতিমধ্যেই কিছু রুপোলি রেখা দেখা দিচ্ছে । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ , মানুষের মনের মধ্যে সাহস দেখা দিচ্ছে , মেন্টাল ইম্যুনিটি !
Post your comments about this news