newsbazar24: ফেসবুক আর ইউটিউবের যুগে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার বেশ কিছু ঐতিহ্যময় ব্রতকথা এবং লোকাচার। যদিও বাংলার গ্রাম গুলিতে , মা-ঠাকুমারা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন এই ব্রতকথা গুলির মাহাত্ম্যকে তাঁদের আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বাস দিয়ে । আর সেই ব্রতকথা গুলির মধ্যে ইতু পুজো হল একটি অতি জনপ্রিয় এবং পরিচিত ব্রত।যা এক সময় প্রতি ঘরে ঘরে মানুষ এই ব্রত পালন করা হত।
অখন্ড বাংলার একটি লোকউৎসব হল ইতু পূজা । প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রত্যেক রবিবার ইহলোকে শস্য বৃদ্ধির কামনায় ও পরলোকে মোক্ষ লাভের ইচ্ছায় ইতু দেবীর পুজা অর্চনা করা হয়ে থাকে। শাস্ত্র মতে কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিনে ইতু পুজোর সূচনা হয়।এক সংক্রান্তি থেকে আরেক সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি রবিবার এই পুজো চলে। অনেকে আবার পয়লা অগ্রহায়ণেও এই পুজো করেন।
ইতু আসলে কে ?
ইতুর এক নাম মিত্র। অনেকের মতে অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য মিত্র নামেই এই পুজোর পরিচিত। প্রতি রবিবার পুজো করা হয় বলে একে সূর্যের পুজোও বলা হয়। অবশ্য ইতু পুজোকে সূর্য উপাসনা বলা হলেও ইতুকে মাতৃকাদেবী রূপেই গণ্য করা হয়ে থাকে। আসলে ইতুর ঘটের গায়ে পুতুলি আঁকা , ভেতরে শস্যদানা ও তৃণগুচ্ছ রাখা আর প্রতীকী শষ্যক্ষেত্র লক্ষ্মী মাতৃপ্রতীক বলেই সবাই মনে করেন।
আজ ও গ্রাম বাংলার মা মাসিরা কার্ত্তিক সংক্রান্তির আগে থেকেই ইতুর পাত্র ও ঘটের পসরা কেনার জন্য দোকানে ভীড় করেন।মালদায় কার্ত্তিক পুজোর মেলায় মাটির বাসন কেনার জন্য অনেকেই ছুটে আসতো । এরপর খড়ের বিঁড়ের উপরেই ইতুর সরাকে বসানো হয়। সেই সরাতে দেওয়া হয় নদী পুকুরের মাটি। মাটি পূর্ণ সরা বা গামলার মাঝে একটি ঘট স্থাপন করতে হয়। বাকী অংশে কলমী, মুলো , সরসে, শুষনীর মূলসহ গাছ, ধানের বীজ, মানকচুর মূল লাগানো হয়। আর তার উপর ছোলা ,মটর, মুগ, তিল, যব সহ আট রকমের ‘শস্য দানা ছড়ানো’ হয়।
মাটিতে লাগানো ইতুর গাছগুলোকে একমাস ধরে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরা বা গামলার মধ্যবর্তীস্থানে রাখা ঘটটিতে জল দেওয়া হয়। প্রতি রবিবার পুজোর সময় এই ঘটে জল দিয়ে থাকে মেয়েরা।
সাধারণত কুমারী, সধবা, বিধবা সব মেয়েরা নিজেই এই পুজো করে থাকেন। প্রার্থনা জানান, যে জ্যোতির দ্বারা তুমি অন্ধকার নষ্ট কর এবং যে কিরণের দ্বারা সকল মানুষের অভাব অনটন দূর কর।
এই ব্রতের পেছনে প্রচলিত কাহিনী কি আছে ? (পাঁচালি )
সব পিঠে রান্না হয়ে গেলে বামুনি বামুন কে পিঠে খেতে দেয়। বামুন তখন দড়ির গিট খোলে আর পিঠে গুনে দেখে গিট অনুযায়ী দুটি পিঠে কম।
বামুনের রাগ দেখে বামুনি ভয়ে তার দুই মেয়েকে দুটো পিঠে দেবার কথা বলে। এই শুনে বামুন তার দুই মেয়েকে তাদের মাসির বাড়ি রেখে আসবে বলে। মেয়ে দুটির নাম উমনো আর ঝুমনো।
পরের দিন ভোর বেলা উমনো আর ঝুমনোকে সঙ্গে করে বামুন বাড়ি থেকে বের হয়। দিনটা ছিল কার্তিক মাসের সংক্রান্তির আগের দিন। সারা দিন চলতে চলতে তারা এক জঙ্গলে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে বামুন তাদের ঘুম পাড়িয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। গভীর রাতে বাঘ,ভালুক এর শব্দে উমনো আর ঝুমনোর ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে তারা খুব কাঁদতে থাকে। কাতর স্বরে ভগবানকে ডাকতে থাকে। শেষে এক বট গাছের কাছে গিয়ে হাত জোর করে দুজনে বলে “হে বট বৃক্ষ! মা আমাদের দশ মাস দশ দিন গর্ভে স্থান দিয়েছেন। তুমি আজ রাতের জন্য তোমার কোটরে স্থান দাও।”
এর পর বট গাছ দু ফাঁক হয়ে গেলে তারা দু বোনে বট গাছের কোটরে রাত কাটায়,সকাল হতে তারা বট গাছকে প্রণাম করে জঙ্গলের পথ ধরে চলতে শুরু করে। চলতে চলতে তারা দেখে সামনে একটা বাড়ি। সেখানে মাটির সরা করে মেয়েরা পুজো করছে। বাড়ির কাছে পৌঁছলে দুটো ফুটফুটে মেয়ে দেখে বাড়ির গিন্নি তাদের সব কথা জিজ্ঞেস করলে তারা কাঁদতে কাঁদতে সব কথা খুলে বলে।
বাড়ির মেয়েরা ঘটে করে কি পূজা করছে জিজ্ঞেস করলে গিন্নি জানায় এর নাম ইতু পুজো। আগের দিন উপোষ করে থাকলে তবেই ইতু পুজো করা যায়। এই কথা শুনে উমনো ঝুমনো বলে কাল থেকে তারা তো কিছুই খায়নি। তখন গিন্নি তাদের পুজোর জোগাড় করে দিলে তারাও কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে ইতু পুজো করে। তাদের নিষ্পাপ ভক্তি দেখে ইতু ভগবান অর্থাৎ সূর্যদেব তাদের বর প্রার্থনা করতে বলে। তারা তাদের বাবার দুঃখ দূর হবার প্রার্থনা জানায়। সূর্যদেব তাদের মনকামনা পূরণ হবার আশীর্বাদ করেন।
এর পর থেকে সেই মাসের প্রত্যেক রবিবার, নিয়ম রীতি মেনে ইতু পুজো করতে থাকে । আর সূর্যদেব তাঁদের ভক্তিতে প্রসন্ন হতে থাকেন।
ওই দিকে বামুনের ঘর ধনে ভরে উঠলেও বামুনির মুখে হাসি নেই। সে খালি মেয়েদের কথা ভাবে আর চোখের জল ফেলে। এই ভাবেই দিন যায়। এক দিন উমনো আর ঝুমনো বাড়ি ফিরে আসে। তা দেখে বামুন বামুনির আনন্দের শেষ থাকেনা। বামুনের অবস্থা তখন ভালই তাই তার মেয়েদের যত্নের শেষ নেই। কিন্তু তারা ইতু পুজোর কথা ভোলে নি,বাড়ি ফিরে তারা আবার পুজো আরম্ভ করে দেয়। তা দেখে বামুন তাদের কি পুজো করছে তা জানতে চায়।তারা ইতু পুজোর কথা বলে,আর সূর্য দেবের আশীর্বাদেই যে তাদের বাবার অবস্থা ভালো হয়েছে সেটাও বলে। তা শুনে বামুনিও ইতু পূজা শুরু করে দেয়। তাদের অবস্থা ক্রমশ ভালো হতে থাকে। এই ভাবে দিকে দিকে এই ইতু পূজার মাহাত্য ছড়িয়ে পড়ে।